Thursday, June 2, 2022

আমাদের মস্তিষ্কের দাম নির্ণয়ের কোনো উপায় আছে কি?

ছোটবেলা থেকেই আমরা একটা কথা শুনে আসছি- মানুষের মস্তিষ্ক নাকি অনেক দামী, অমূল্য; এর অপরিসীম ক্ষমতা -এরকম অনেক কিছু।

কিন্তু সেটা কিভাবে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা বাস্তব বা প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ ছাড়াই না বুঝে বিশ্বাস করার মতো একটা ব্যাপার ছিলো।

যেমন, আমরা বিশ্বাস করি, "শিক্ষাই দারিদ্র বিমোচনের মূল অস্ত্র।" কিন্তু শিক্ষা কিভাবে দারিদ্রতা দূর করে, সেটা সরাসরি অনেকেই জানি না, বা জানার চেষ্টা করি না। সচারাচর দেখা যায়, শিক্ষিতদের চেয়ে ব্যবসায়ীরাই বেশি অর্থবিত্তের অধিকারী। অথচ তারপরও শিক্ষাকে দারিদ্র্য বিমোচনের অস্ত্র হিসেবেই আমরা চোখ বুঝে মেনে নিই। আমরা কিন্তু কখনোই বলি না যে, "ব্যবসা দারিদ্র বিমোচনের অস্ত্র"। 

তেমনি ভাবে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই মস্তিষ্ককে মেনে নিই দেহের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ হিসেবে।

কিন্ত আমার প্রশ্ন হচ্ছে, "মস্তিষ্ক, মাত্র ১৩৬৬ গ্রাম (male) ওজনের খুবই ছোট একটি জিনিস, সেটাকে এত মূল্যবান কেন বলা হয়? আমাদের এত বড় একটা দেহে হাত, পা, কিডনি, হার্ট সহ আরও কত অঙ্গ আছে। সেগুলোকে তো এতোটা মূল্য দেয়া হয় না। 

এই বস্তুটার এতোই দাম যে , আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর তাঁর মস্তিষ্ক নাকি চুরি পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর কারন বের করার দায়িত্বে ছিলেন- ডা. হার্ভি নামে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক। তিনি কৌতূহল বশত (আইনস্টাইনের পরিবারের নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্তেও) ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ককে মাথা থেকে পৃথক করে কেঁটে ২৪০টি ব্লকে ভাগ করে ১০০০ এর বেশি স্লাইড তৈরি করে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষকদের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই গবেষণাও এটাই প্রামাণ করে যে, মস্তিষ্ক আসলেই দামী একটা কিছু। 

আচ্ছা, বুঝলাম, আইনস্টাইন পৃথিবীর কিংবদন্তি মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন, তাই হয়তো তাঁর মস্তিষ্ক নিয়ে এতো কৌতূহল। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের মস্তিষ্ককে কিভাবে দামী বলবো? আমরা তো আজ পর্যন্ত তেমন কিছুই আবিষ্কার করলাম না, বা তেমন বিশেষ কিছু করার চেষ্টাও করি না। তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের কি কোনোই মূল্য নেই? 

এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়েই আজকের এই লেখা। আমাদের মস্তিষ্কের মূল্য আছে, নাকি নেই সেটা বলার আগে কয়েকটা তথ্য দেই। 

আমি যদি আপনাকে বলি, আপনার মস্তিষ্ককে প্রতিদিন মাত্র কয়েক মুহূর্ত ভাড়া নেয়ার জন্য পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ টোপ পেতে বসে আছে। 

অন্য কারও মস্তিষ্ক না, আপনারটা-ই। 

তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন? 

বিশ্বাস না করার-ই কথা।

আপনি যদি আমার লেখাটার এই পর্যন্ত পড়েই থাকেন, তাহলে আমি বলবো- আপনিও কিন্তু আমার বড়শীর টোপে আটকে গেছেন। আপনার মস্তিষ্ককে কিন্তু এই মুহুর্তে আমি-ই নিয়ন্ত্রণ করতেছি!

হা-হা-হা, অবাক লাগছে! তাই না?

আচ্ছা, আর একটু ভেঙ্গে বলি। আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে যদি ৫০০ জন ফ্রেন্ড থাকে, তাদের মধ্য থেকে যদি দিনে মাত্র ৫০ জনও কোনো স্ট্যাটাস দেয়, তাহলে সেই ৫০ জনই কিন্তু আপনার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কারন সবার স্ট্যাটাস এর পিছনেই একটা প্রধান উদ্দেশ্য থাকে- এটি যেন বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছায় এবং বেশি মানুষ পড়ে / রিয়াকশন দেয় / কমেন্ট করে। 

শুধু আপনার বন্ধু-বান্ধব ই যে এই কাজ করে যাচ্ছে এমনটা কিন্তু নয়। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আপনার পিছনে লেগে আছে। 

তো, সেটা কিভাবে?

আপনি ইউটিউবে যে ভিডিও দেখেন, সেখানে মাঝেমধ্যে যে অ্যাড (বিজ্ঞাপন) গুলো আসে, সেই অ্যাড এর পিছনে কোম্পানির মালিকরা কী পরিমান টাকা খরচ করেন সে সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে কি? 

জেনে অবাক হবেন, শুধুমাত্র গ্রামীণফোন-ই ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত মাত্র ৫ বছরে অনলাইন বিজ্ঞাপনের পিছনে ৪৩ কোটি ৩১ লক্ষ ২৫ হাজার ৬২৯ ডলার (টাকা না কিন্তু, অ্যামেরিকান ডলার; বর্তমানে ১ ডলার = ৮৯.১০ টাকা) খরচ করেছে। 

এরকম দেশ বা পৃথিবীর ছোট-বড় প্রায় সব কোম্পানিই আপনাকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড ধরে একটা বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্য আকুল হয়ে বসে আছে। 

আপনার হয়তো মনে হচ্ছে, এই টাকা তো তারা একসাথে সবার পিছনেই খরচ করছে। আমার একার পিছনে তো করে না। 

কিন্তু বিষয়টা আসলে এমন না। এরা সবার পিছনে টাকা খরচ করতেছে মনে হলেও, তারা কিন্তু প্রতিটি মানুষকে আলাদাভাবেই টার্গেট করার চেষ্টা করে। আপনি কখন কী পছন্দ করেন, আপনার এখন কোন জিনিসটা দরকার তা কিন্তু আপনার চেয়েও তারা ভালো জানে।

ধরুন, কোনো একটা কোম্পানি ১০০ জন মানুষের কাছে একটা বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দেয়ার প্লান করলো। সেজন্য তারা ২ হাজার টাকা খরচ করলো। তাহলেও কিন্তু আপনার পিছনে তারা গড়ে ২০ টাকা খরচ করলো। 

এভাবে একইসাথে অন্য ধরণের কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান গুলোও তো খরচ করতেছে। এভাবে যদি ৫০০টি কোম্পানিও খরচ করে তাহলে কিন্তু দৈনিক আপনার পিছনে ১০ হাজার টাকা কেউ না কেউ খরচ করে চলছে। 

এটা তো বোঝার সুবিধার্থে ছোট একটা এক্সাম্পল মাত্র। কিন্তু আমার মনে হয় বাস্তবে একজন মানুষের পিছনে পৃথিবীর সবগুলো কোম্পানি গড়ে দৈনিক কোটি কোটি টাকা খরচ করে।

কিন্তু এতে তাদের লাভ কী?

লাভ হলো সেটা-ই। অর্থাৎ আপনার মস্তিষ্ক-কে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভাড়া নিয়ে আপনার সম্পূর্ণ দেহকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা। কারন আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে যে নির্দেশ দিবে আপনি কিন্তু ঠিক সেটাই করবেন।

আপনি একটা কলম কিনেন, বা একটা গাড়ি কিনেন, অথবা, কারও কথায় মুগ্ধ হয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিসিশন নিলেন - সবই কিন্তু ঐ মস্তিষ্ক-ই নিয়ন্ত্রণ করতেছে।

তাই কোম্পানি বা যেকোনো প্রতিষ্ঠান ভালো করেই জানে, আপনার মস্তিষ্ককে যদি কোনো ভাবে এক মুহুর্তের জন্যও নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় তাহলে আপনার পকেট থেকে বিশাল কিছু চোখের অগোচরেই নিয়ে নেয়া সম্ভব।

তাহলে এখনও বলবেন আপনার মস্তিষ্কের তেমন দাম নেই? 

যদি দাম না-ই থাকে তাহলে এত টাকা তারা কী জন্য খরচ করতেছে?

আসলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের মস্তিষ্কেরও অনেক দাম। অপরিসীম দাম। কিন্তু আমরা সেটা সহজে আদায় করে নিতে পারি না। মস্তিষ্কের দাম বাড়ানোর জন্য কোনো কাজ করা শুরু করলেই ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিভিশন, ক্রিকেট, ফুটবল, আড্ডা-বাজি সবকিছু এসে বাঁধা দেয়া শুরু করে, আর তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নেয়।

মূলত আমাদের মস্তিষ্কের রাজ প্রাসাদ থেকে ধন-সম্পদ গুলো প্রতিদিন এরকম হাজারো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছিনতাই করে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। তাই আমাদের মস্তিষ্কের দাম আর বাড়ে না। 

আচ্ছা, আপনি আইনস্টাইনের ছবি দেখলে কি চিনতে পারবেন? আমি বলবো- 'না'। 

আমি শিওর, আপনি কাজী নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ুন আহমেদ এরকম কোনো বিখ্যাত মানুষকেই চিনবেন না। 

কী?! আমাকে বোকা মনে হচ্ছে?

আসলে আমরা আইনস্টাইনকে যে 'আইনস্টাইন' হিসেবে চিনি, তা কিন্তু তাঁর মাত্র ১২৩০ গ্রাম ওজনের মস্তিষ্কটার কারনেই। (তাঁর মস্তিষ্কের ওজন সাধারণ পুরুষদের চেয়ে একটু কম ছিলো।) তাঁর সুদর্শন দেহ, গোঁফ বা পোশাক বা এরকম কিছুর জন্য কিন্তু তিনি আপনার কাছে পরিচিত হননি। তাঁর মস্তিষ্কের অভূতপূর্ব কাজের জন্যই আমরা তাঁর অন্য সবকিছু চিনেছি।

তাই শেষ কথা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার চেয়েও বেশি মূল্যবান- নিজের মস্তিষ্ককে ভালোবাসতে চেষ্টা করুন। খেয়াল রাখুন, 'মস্তিষ্ক' নামের আপনার এই রাজপ্রাসাদের সম্পদ গুলো অন্য সবাই একেবারে লুটপাট করে যেন শেষ করে না দেয়! আপনি-আমি সবাই-ই এই লুটপাটে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছি।


References:

Grameenphone, Robi, Banglalink pay Tk 87b online ads | Prothom Alo

আইনস্টাইনের ব্রেইন চুরির গল্প! - 10 Minute School Blog

আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অন্যরকম? | প্রথম আলো (prothomalo.com)

Human brain - Wikipedia

Share: