"নিজেকে ভালোবাসি" - খুবই সহজ ও অতি পরিচিত একটি বাক্য হলেও এটি যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যা ও আনুমানিক একটি ধারণা মাত্র, যা বেশিরভাগ সময়ই মানুষের স্বাভাবিক চিন্তায় পরিলক্ষিত হয় না। অত্যন্ত বড় একটি সত্য হচ্ছে- অন্য কাউকে ভালোবাসা যতটা সহজ, নিজেকে ভালোবাসা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
কেন কঠিন - সেটি বোঝার জন্য সবার আগে আমরা 'ভালোবাসা' (Love) এবং 'নিজ' বা 'আত্ম' (Self) শব্দদ্বয়কে একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।
আজ আমি অপর মানুষকে ভালোবাসা সম্পর্কে বলবো না। আবার অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নিজ ভালোবাসায় লিপ্ত থেকে স্বার্থপরতা বিশেষণে বিশেষায়িত হতে হবে, এমন কোনো উদ্দেশ্যে নিয়েও বলবো না। কী বলবো সেটা কিছুদূর পড়লেই বোধগম্য হবে।
তাহলে এখন শুরু করা যাক...
'ভালোবাসা' (Love) শব্দটি সবার কাছেই অতি পরিচিত একটি শব্দ। নিজ বা অন্য কোনো ব্যক্তির উপর ভালোবাসা বলতে বোঝায়- সেই ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক সহ সব কিছুতে মঙ্গল কামনা করা এবং অবশ্যই সেই অনুসারে যেকোনো পদক্ষেপ নেয়া। অর্থাৎ স্বেচ্ছায় এমন কোনো কাজ করার কারনে যদি উক্ত ব্যক্তির ঐসব দিক গুলোর একটিতেও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে বলতে হবে- এই ভালোবাসা শুধুই নাম মাত্র ভালোবাসা। এটা মিথ্যা!
এবারে বলবো- 'নিজ' বা 'আত্ম' সম্পর্কে।
'নিজ' অতি ক্ষুদ্র একটি শব্দ হলেও এর পরিধি কিন্তু ব্যপক। 'নিজ' বলতে একটা মানুষের বিভিন্ন দিককে ইঙ্গিত করে।
যেমন-
১. দেহ
২. ব্যক্তিসত্তা / আত্মিক মর্যাদা (মনুষ্যত্ব)
৩. পরিবারের সদস্যদের মর্যাদা (Which are depended on self)
৪. নিজের কর্মকান্ডের উপর সামাজিক প্রভাব / দৃষ্টিভঙ্গি
সবার আগে ১ ও ২ নং পয়েন্ট এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে মূল অংশে যাবো।
এখানে, ১ নং পয়েন্টে 'দেহ' বলতে একটা মানবদেহের ছোট-বড় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কে বোঝায়। সেটা হতে পারে চোখ, মুখ, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, ক্ষুদ্রান্ত, বৃহদান্ত্র ইত্যাদি। এমনকি সেটা হতে পারে আমাদের জননাঙ্গ; হতে পারে সেটা যেকোনো ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষ। অর্থাৎ ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষ সমৃদ্ধ একটা হিউম্যান বডির যেকোনো অংশকেই এই 'দেহ' বোঝাবে।
এবারে আসি ২নং পয়েন্টের 'ব্যক্তিস্বত্তা' বা 'আত্মিক মর্যাদা' নিয়ে। একটি মানুষকে কিন্তু আমরা তার সুঠাম দেহ ও বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে সর্বাঙ্গীণ বিচার করি না। একজন মানুষ অন্যদের কাছে আন্তরিকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তার আত্মিক মর্যাদা বা মনুষ্যত্ব সবচেয়ে বেশি জরুরি।
এখন নিজেকে ভালোবাসার প্রথম যে বিষয়টি বলেছিলাম, সেটিতে আবার ফিরে আসি। অর্থাৎ দেহকে ভালোবাসা।
আমি যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি আপনার দেহকে ভালোবাসেন? তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই 'হ্যাঁ' বোধক উত্তর আসার সম্ভাবনা। কিন্তু আমি বলবো এটা 'হ্যাঁ' বোধক মনে হলেও এর মধ্যে যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে।
নিজ দেহকে ভালোবাসার শর্তটি ছিলো- দেহের কোনো অঙ্গের ক্ষতি হবে এমন একটি কাজও জেনে শুনে ইচ্ছাকৃত ভাবে না করা।
কিন্তু দেখা যায় প্রতিনিয়ত আমরা সবকিছু জানা স্বত্বেও বিভিন্নভাবে নিজ দেহের ক্ষতি করে যাচ্ছি। তন্মধ্যে কয়েকটা উদাহরণ দেই।
প্রথমেই একজন ধূমপায়ীকে নিয়ে একটু কথা বলি। তিনি তো শুধুমাত্র কয়েক মুহুর্ত মরিচীকাময় একটু তৃপ্তির লক্ষ্যে দুই ঠোঁটের মাঝে সিগারেটের শলাকা চেপে প্রতিনিয়ত ধূম টেনে যাচ্ছেন; আর দিন দিন নিজের ফুসফুসকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অথচ তিনিও বলেন, 'আমি নিজকে ভালোবাসি। তিনি যদি নিজকেই ভালোবাসেন তাহলে নিজকে কেন স্ব-ইচ্ছায় দীর্ঘমেয়াদি আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাবেন?
আবার, বর্তমান সমাজে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অতি পরিচিত একটি বদ অভ্যাস আছে; যেটি নিয়ে বললে অনেকের কাছেই লজ্জাজনক বা বিব্রতকর মনে হতে পারে। তারপরও আমি মনে করি, এটি নিয়ে বলা উচিত। কারন আমরা সাময়িক কয়েক মুহুর্ত শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তির লক্ষ্যে দেহের এমন একটি বিশেষ অঙ্গের সাথে অবিচার করি, যে কাজ ধীরে ধীরে একটা মানুষের ভবিষ্যৎ প্রজনন ক্ষমতাকে নষ্টের দিকে ধাবিত করে। পরিপূর্ণ নষ্ট না হলেও শারীরিক ভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
হ্যাঁ, আমি ঐ শব্দটি নিয়েই বলতেছি, যা আপনি ভাবতেছেন! যেটার শুরুতে 'হস্ত' ও শেষে 'মৈথুন' রয়েছে। এটি এমন-ই একটি শব্দ যা মানুষের মুখে উচ্চারিত হয় খুবই কম, কিন্তু এই শব্দের প্রাকটিক্যাল ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।
তাহলে জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ কেন আমরা করেই যাবো, যেটা আমাদের দেহ ও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিবে? অথচ তারপরও আমরা মনে করি, আমরা নিজেকে ভালোবাসি!
নিজ দেহকে ভালোবাসা নামের অবিচারের এরকম আরও অনেক কর্মকাণ্ড বা অঙ্গ নিয়ে বলা যায়। আমি শুধুমাত্র দুটি উদাহরণ টেনেই বাকীগুলোর ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করলাম।
এবারে নিজকে ভালোবাসা বা Self Love এর ২নং পয়েন্ট- 'ব্যক্তিসত্তা' বা 'আত্মিক মর্যাদা' নিয়ে কথা বলা যাক।
সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন এবং তাদের রয়েছে নানান ধরণের কাজের দায়িত্ব। আর একজন মানুষের দ্বারা সম্পাদিত যেকোনো কাজই তার 'আত্মিক মর্যাদা' নামক মানদন্ডকে ধীরে ধীরে গড়তে থাকে৷
একজন শিক্ষক যদি তার শিক্ষার মধ্যে কোনো অনৈতিকতা ঢুকিয়ে ফেলেন তাহলে তার এই মানদন্ড সেই অনুসারেই গড়তে থাকবে। বর্তমানে কিছু কিছু শিক্ষকদের দেখা যায়, তারা শিক্ষাকে এমন কিছু অনৈতিক কর্মকান্ডের অস্র হিসেবে ব্যবহার করেন, যা সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের বোধগম্যের বাহিরে থাকে।
হয়তো তিনি ঐ কর্মকান্ড থেকে সাময়িক কিছুটা লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু সেটা কি তার আত্মমর্যাদা থেকে অনেক বেশি? তার আত্মমর্যাদা মানেই তো তিনি নিজে, তাই না? তাহলে তিনি কিভাবে নিজেকে ভালোবাসেন? তিনি হয়তো শুধু নিজ দেহকেই ভালোবাসেন!
এটা কি শুধুমাত্র শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই? মোটেও না।
আমি মাত্র কয়েকটা উদাহরণ দেই।
- কিছু কিছু ডাক্তার তার চিকিৎসা বিদ্যা দিয়ে রোগীদের এমনভাবে প্রতারিত করছেন, যার প্রভাব বুঝতে গেলে উক্ত রোগীর আবারও প্রতারণার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷
- কিছু কিছু পুলিশ 'মানবতাই সেবা' নামক পবিত্র একটি ট্যাগকে ব্যবহার করে সাধারণ জনগণের সাথে এমন নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত হয়, যাতে তার 'মনুষ্যত্ব ' নামক বিশেষন মাঝেমধ্যে 'পশুত্ব' বিশেষনে পরিণত হয়।
- একজন রাজনীতিবিদ 'রাজার নীতি' নামের খুব দামী একটি ট্যাগ ব্যববার করেন। কিন্তু তিনি করেন কী? একটুখানি পরিচিতি, একটুখানি অর্থবিত্তের মোহ, একটুখানি প্রভাব-প্রতিপত্তির অংশীদার হওয়ার জন্য তাকে কতই না অভিনয়ের ছল-চাতুরীতে অংশ নিতে হয়! জেনে বুঝেও অযোগ্য কোনো মানুষকে কতই না মিথ্যা প্রশংসার সাগরে ভরপুর করে দিতে হয়। আর নিজের নামে 'জনপ্রিয়', 'জনদরদী', 'দেশবন্ধু', 'সৎ, 'নিষ্ঠাবান' নামক কতই না ট্যাগ লাগিয়ে দেন, যার বিন্দুমাত্রও তার মধ্যে নেই। খোঁজ নিলে দেখা যায় এগুলোর বিপরীত ট্যাগগুলো সবই তার মধ্যে আছে।
তিনিও কিন্তু ভালো করেই জানেন, এসব ট্যাগ বা নেতাদের মিথ্যা প্রশংসার অধিকাংশই অভিনয়, এটা শুধুমাত্র একটা সিস্টেম।
অথচ এই লোকরাও মনে মনে দাবী করেন, তারা নাকি নিজকে ভালোবাসেন। নিজ পরিবারকে ভালোবাসেন।কিভাবে? কিভাবে সম্ভব?
নিজের কথাকে, নিজের কর্মকান্ডকে ধূলির সাথে মিশিয়ে যাচ্ছেতাই কাজে জড়িত হওয়ার পরেও যদি বলেন 'আমি নিজকে ভালোবাসি', তা কিভাবে সম্ভব? এতে তো মনে হয় সেই মানুষটি শুধুমাত্র একটা 'দেহ' দিয়েই গঠিত। আর কিছুই তার মধ্যে নেই।
Self Love বা নিজকে ভালোবাসার ৪ ও ৫নং পয়েন্ট অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের মর্যাদা এবং সামাজিক প্রভাব উভয়ই নিজ কর্মকান্ডের উপর নির্ভর করে। এজন্য দেহ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়।
একজন ঘুষখোর মনে করেন, তিনি নিজের স্বার্থে ও পরিবারের সদস্যদের উপকার এর জন্য ঘুষ খাচ্ছেন। কিন্তু এটা কি মোটেই সঠিক? তার সন্তান বা স্বজনরা ঘুষের টাকা দিয়ে যতই বিলাসি জীবনযাপন করুক সে তো একজন ঘুষখোরের সন্তান। ঐ সন্তানের 'বাবা' পরিচয় কে তো তিনি দূষিত করে দিয়েছেন। তাহলে তিনি কিভাবে নিজ পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসেন?
আবার একজন সুদখোর নিপিড়ীতদের কাছ থেকে সুদ নিতে নিতে হয়তো প্রচন্ড বিলাসবহুল একটা লাইফস্টাইলেই চলে যান। কিন্তু সমাজের লোকজন সামনে ভালো ব্যবহারের অভিনয় করলেও পিছনে তো ঠিকই 'সুদখোর' বলে গালি দিচ্ছে।
তো এই গালির জন্য দায়ী কে? সেই সুদখোর স্ব-ইচ্ছায় ই তো নিজেকে সুদের সাথে জড়িত করে নিজ সামাজিক মর্যাদাকে নষ্ট করলেন।
নিজের পরিচয়কে নিজে বিষাক্ত করেও যদি তিনি বলেন, "আমি নিজেকে ভালোবাসি। নিজ পরিবারকে ভালোবাসি।" তাহলে সেটা কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য হবে?
অতএব, নিজেকে ভালোবাসা এতো সহজ কোনো কথা নয়। যেকোনো উপায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া, সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়া, পরিবারের সদস্যদের বিলাসবহুল লাইফস্টাইল উপহার দেয়া, আর সর্বদা চাটুকারদের মিথ্যা প্রশংসার বাক্য শুনতে পারা মানেই নিজেকে ভালোবাসা নয়।
নিজকে ভালোবাসতে হলে সম্পূর্ণ দেহের কোনো একটি অঙ্গের বিন্দুমাত্র মঙ্গল লঙ্ঘন হবে এমন একটি কাজও স্বজ্ঞানে করা উচিত হবে না। আর সেই দেহের কোনো অঙ্গ দিয়ে (যথাসম্ভব) একটি কাজও করা যাবে না, যেটি নিজের মনুষ্যত্ব, পরিবারের সদস্যদের মর্যাদা ও সামাজিক মর্যাদা -কে বিনষ্ট করে। তাহলেই নিজেকে ভালোবাসা সম্ভব হবে।
নিজেকেই যদি সঠিকভাবে ভালোবাসতে না পারা যায়, তাহলে আবার কিভাবে অন্যদের ভালোবাসা যাবে?!