আমরা সবাই-ই জানি, 'মৃত্যু' একটা অবশ্যম্ভাবী সত্য। কিন্তু তারপরও এটিকে সত্য বা যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে - এমন মনে হয় না কেন?
অর্থাৎ আমরা সবাই-ই এটা ১০০% বিশ্বাস করি, কিন্তু মৃত্যু যে ১ সেকেন্ড পরেও ঘটতে পারে, বা এই লেখাটি পড়ে শেষ করার আগেই আপনার মৃত্যু এসে যেতে পারে - এমন মনে হয় না কেন?
আমি কিছুটা চিন্তাভাবনা করে একটা কারন বের করার চেষ্টা করেছি। আর এর সাথে কিছু সমাধানও দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। তবে আমার জানার বাহিরে আরও বিভিন্ন কারন থাকতে পারে। সেরকম কোনো কারন / সমাধান আপনার জানা থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন।
এবারে বলি, আমার ধারণামতে সেই কারনটি কী হতে পারে?
আসলে আমরা জন্মের পর থেকে প্রতিটি দিন বা রাত-ই পরিপূর্ণ ভাবে পেয়েছি। একটু চিন্তা করে দেখেন, যার বয়স এখন ২০, সে (আনুমানিক) ৭,৩০০ টি দিন পেয়েছে। আর এতগুলো দিনের প্রতিটির শেষেই সে বেঁচে ছিলো। অর্থাৎ ৭,৩০০ বার তার মস্তিষ্ক একটা রেজাল্ট-ই পেয়েছে; যে- ২৪ ঘন্টার দীর্ঘ একটা দিনের পর বেঁচে থাকা সম্ভব।
এই একই আউটপুট বার বার পেতে পেতে আমাদের অবচেতন মন (Subconscious Mind) ধরেই নিয়েছে যে- আগামীকালও আমরা আগের দিনগুলোর মতোই বেঁচে থাকবো।
আরেকটু সহজ করে যদি বলি,
কোনো কিছু খাওয়ার সময় আমাদের কি মনে করে নিতে হয় যে এটি 'মুখ' দিয়ে খেতে হবে? নাকি 'নাক' দিয়ে? খাবার হাতে নিলেই তো সেটা স্বয়ংক্রীয়ভাবে মুখের দিকে চলে যায়।
অর্থাৎ জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে মুখ দিয়ে খাওয়ার সিস্টেমটি একবার শিখে নেয়ার পর লক্ষ লক্ষ বার একই কাজ করতে করতে এখন আমাদের মস্তিষ্ক ধরেই নিয়েছে যে- হাতে কোনো খাবার নিলেই সেটা মুখের দিকে নিয়ে যেতে হবে৷ তাহলেই সেই খাবার পরিপাক / হজমের দিকে চলে যাবে।
তো, জন্মের পর থেকে আমাদের তো এখন পর্যন্ত একটি বারও মৃত্যু হয়নি। তাহলে কিভাবে মস্তিষ্ক সব সময় ধরে নিবে যে এটা যেকোনো সময় ঘটতে পারে?!
অর্থাৎ, মৃত্যু নামক এই সত্যটি আমাদের মস্তিষ্কে শুধুমাত্র তাত্ত্বিকভাবে (Theoretically) ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব। ব্যবহারিকভাবে (Practically) প্রয়োগ করা প্রায় অসম্ভব।
এখন আমার এই লজিকের বিরুদ্ধেই আপনি একটি 'অ্যান্টি লজিক' দাঁড় করাতে পারেন। সেটি হচ্ছে, মস্তিষ্ক বা সাবকনসাস মাইন্ডকে কোনো কিছু সত্য মনে করাতে হলে যদি সেটি বাস্তবে করিয়েই নিতে হয়, তাহলে আমরা যখন ৫ তলা কোনো বিল্ডিং এর ছাদের কর্ণারে যাই, তখন মনের ভিতর থেকে স্বয়ংক্রীয়ভাবে একটা বাঁধা এসে যায় কেন যে, "ওখান থেকে পরে গেলেই মৃত্যু!" ৫ তলা থেকে লাফ দেয়ার এক্সপেরিয়েন্স তো আমাদের একবারও নেই। তাহলে মস্তিষ্ক এটা কিভাবে বুঝে নিলো?
তাহলে কি এখন বলবেন যে মৃত্যু ভোলানোর পিছনে আমি এতক্ষণ যে কারনটা বললাম সেটি অযৌক্তিক বা ভিত্তিহীন?
না, আমার মনে হচ্ছে- আমার বলা কারন টা ঠিক-ই আছে। তবে এই অ্যান্টি লজিকের উত্তর যদি দিতে হয় তাহলে আর একটু কথা বলতে হবে।
অন্যান্য বিভিন্ন কাজের ফলাফল কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমাদের অবচেতন মনে রেকর্ড হয়ে গেলেও, ‘মৃত্যু’ নামক ব্যাপারটি যেন আমাদের অবচেতন মনে কোনোভাবেই স্থায়ী হয়ে না যেতে পারে সেজন্য কেউ একজন নিয়মিত কন্ট্রোল করে যাচ্ছে।
আমার ধর্ম- ইসলামের ভাষায় সেটি হচ্ছে ‘ইবলিশ / শয়তান’। অন্য ধর্মে অন্য কিছু হতে পারে। বিজ্ঞানের ভাষায় সেটির কোনো কন্ট্রোলার নাও থাকতে পারে। আবার থাকতেও পারে।
তো, এখন আবার আগের কথাটিতে ফিরে আসি।
আমি বলেছিলাম- মৃত্যু’র ব্যবহারিক প্রয়োগ করে জ্ঞান অর্জন করা অসম্ভব। তবে ব্যবহারিক প্রয়োগ যে একেবারেই সম্ভব না, এমনও নয়। অন্যের মৃত্যু দেখে কিছুটা হলেও ব্যবহারিক এর স্বাদ পাওয়া যায়।
কিন্তু আপনি কোনো ল্যাব ওয়ার্কে যদি শুধুমাত্র অন্যের ব্যবহারিক করাই দেখেন, আর নিজে একটুও না করেন, তাহলে তো সেই এক্সপেরিমেন্ট এর অনেকাংশেই আপনার কাছে অপূর্ণ থেকে যাবে।
তাই বলে মৃত্যু নামক এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কেও পরিপূর্ণ ধারণা নিতে গিয়ে যদি আপনি ব্যবহারিক-ই (Suicide) করে ফেলেন তাহলে তো আর কিছুই থাকলো না। একুল-ওকুল সব-ই যাবে!!!
তাহলে মৃত্যু কে সত্য মনে না হওয়ার সমাধানটা কী হতে পারে? আমরা কি অপ্রস্তুত ভাবেই মৃত্যু নামক এক্সপেরিমেন্ট এর প্রোডাক্ট হয়ে যাবো?
স্কুল কলেজের ছোট-খাটো একটা এক্সামের জন্যও আমরা কত প্রিপারেশন নেই! প্রিপারেশন ছাড়া কোনো এক্সাম মানেই মনে করি খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তাহলে মৃত্যুর মতো এত বড় একটি এক্সাম / এক্সপেরিমেন্ট কোনো রকম প্রিপারেশন ছাড়াই দিয়ে দিবো?
আমার মনে হচ্ছে- কোনো একটা সমাধান অবশ্যই আছে। কারন সবাই তো আর অপ্রস্তুত অবস্থায় মৃত্যুতে পতিত হয় না, কেউ কেউ প্রস্তুত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ বা মৃত্যুকে বরণ করে নেয়।
আমার ধারণা, সেরকম একটি সলিউশন হচ্ছে- প্রতিদিন এমন কোনো একটা কাজ বার বার করা, যাতে মস্তিষ্ক ও অবচেতন মনকে যেকোনো ভাবে বুঝানো সম্ভব হয় যে ‘মৃত্যু যেকোনো সময় ঘটতে পারে’।
আর, আমি একটু আগে ‘ইবলিশ’ নামক যে ‘মৃত্যু ভোলানো’ একজন কন্ট্রোলার এর কথা বলেছিলাম সবার আগে আমাদের সেটিকে কন্ট্রোল করতে না দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। বরং আমরা যেন ইবলিশ-কে কন্ট্রোল করতে পারি সেরকম কোনো উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
এখন সেরকম কাজ কী হতে পারে?
আমার ধর্ম মতে আমাদের মস্তিষ্ক বানিয়েছেন স্বয়ং 'আল্লাহ'। তো, মস্তিষ্কের এই নির্মাতাই তাঁর বানানো মস্তিষ্ককে আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রন করবো তার পরিপূর্ণ ম্যানুয়াল বা গাইডলাইন আমাদেরকে দিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের প্রতিদিনের রুটিনে সেরকম বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিস শিডিউল করে রেখেছেন, যাতে আমরা সেই ‘মৃত্যু ভোলানো’ কন্ট্রোলারকে নিয়ন্ত্রন করতে পারি।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- আমরা কয়জন মানুষ সেই ম্যানুয়াল অনুসরন করে মস্তিষ্ককে চালনা করি? আমি নিজেও অনেকটাই করি না। আর সেজন্যই তো নিত্যদিন পরিচিত অপরিচিত অনেক মানুষকেই দেখি অপ্রস্তুত অবস্থায় ‘মৃত্যু’ নামক এক্সপেরিমেন্টে পতিত হয়। তাই আমাদের মনও বুঝে নিয়েছে- এতো মানুষ যখন সাধারণ ভাবেই মৃত্যুতে পতিত হচ্ছে, তাই আমাদেরও কিছু হবে না। কারন তারা তো মৃত্যুর পর আমাদেরকে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা জানিয়ে যেতে পারছে না।
শেষে এটাই বলবো, আমাদের মস্তিষ্ক / দেহের সেই নির্মাতা সকলকে এই এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার সক্ষমতা দান করুক। যাতে মৃত্যুতে পতিত না হয়ে মৃত্যুবরণ বা মৃত্যুকে বরণ করার জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত করে, সেই এক্সপেরিমেন্ট এ ভ্যালিড প্রোডাক্ট হিসেবে নিজেদের সপে দিতে পারি।